কবি নাসির ওয়াদেনের সাক্ষাৎকার




একটি সাক্ষাত্কার যা নিছক ব্যক্তিমানুষের বা কবি মানুষের সাক্ষাত্কার নয় । একজন কবি ও সমালোচকের চোখে একটি কনসেপ্টের অবস্থান কী , সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে রইল এই সাক্ষাত্কার ।

কবি নাসির ওয়াদেন বীরভূম নিবাসী সিনিয়র কবি । কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ,  সমালোচনামূলক নিবন্ধ , ছোটগল্প এবং বিভিন্ন ম্যাগে লিখে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে । তাঁর সাক্ষাত্কার ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে থাকে একটি যুগের সাথে পরবর্তী যুগের প্রবহমানতার ফারাক ও বৈশিষ্ট্য কারণ তিনি জীবন দিয়ে দেখেছেন সময় । তাই তাঁর সাক্ষাত্কার আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

এবং এই সিনিয়র কবির সাক্ষাত্কার নিয়েছেন আর এক সিনিয়র কবি কুমারেশ তেওয়ারী  । আসানসোলের বাসিন্দা এই কবিকে আর নতুন করে চেনানোর প্রয়োজন নেই কারণ দুই কৃত্তিবাস দেশ  কবিতা আশ্রম কবিতা পাক্ষিক সহ পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সারির সব পত্রিকাতেই তাঁকে দেখা যায় এবং অন্যান্য লিটলম্যাগে ও । নিরহঙ্কার এই কবি নিজেই ভাস্বর।



১)        জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট সংক্রান্তই হবে, তবু আমি আপনার কবিতা যাপন সম্পর্কে কিছু জানতে চাইব ।

উত্তর :   জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট আলোচনার পূর্বে আমার কবিতা যাপন বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলতে চাই যে, কবিরা জন্মসূত্রে ছন্দের    দোলায়, সুরের মুর্ছনায় সিক্ত এবং স্বপ্নদর্শী। "We are the music makers, we are the dreamers of dreams",।  কবিতা যাপন বলতে দ্বিধা নেই যে, কবিতা লেখা বা তার সঙ্গে লেগে থাকা একটা আবেগ,অনুভবের তাগিদ মাত্র। বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত থাকার  ফলে অবসর পেলে কবিতা লিখে থাকি। শব্দ নিয়ে ভাবতে থাকি, মনের রসে জারিত হয়ে অভিনব আঙ্গিকে রূপ দেওয়ার  চেষ্টা করে কবিতা লিখি। অনেকটা মনের খেয়ালিপনা থেকেই আনন্দ আস্বাদন করা আর কি, আবেগ রঞ্জিত কল্পনাকে রূপ দেওয়ার মতো। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কবিতা লেখা বা চর্চার ধারাবাহিক প্রবণতা নেই, তাই কবিতা যাপন অনিয়মিত ও অশৃঙ্খলিত এবং অনির্দিষ্ট।




২)        যেকোনো শিল্প মাধ্যমই তো নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ করে দেয়। কবিতাও তাই। এখন প্রশ্ন হলো আপনি কবিতাকেই কেন বাছলেন নিজেকে প্রকাশ করার জন্য? 


উত্তর : ঠিক তাই ,প্রত্যেকের ভেতরে যে প্রতিভা  সুপ্ত থাকে, তার প্রকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রও বিভিন্ন । কেউ শিল্পের মাধ্যমে তুলির আঁচড় কেটে, কেউ গদ্য ভাষায় কাহিনী দিয়ে গল্পে,উপন্যাসের মাধ্যমে, আবার কেউ কেউ কবিতা যাপনের দ্বারা। কিন্তু কবি হওয়া খুবই কঠিন কাজ। বিষয় বস্তু ভারাক্রান্ত না করে স্বল্প পরিসরে একটি চিত্রকল্প এঁকে মনের ইচ্ছাকে শিল্পরূপ দেওয়া। আমার ক্ষেত্রে কবিতাই অন্যতম মাধ্যম। আমি ছোট বেলা থেকেই কবিতাকে ভালবেসে ফেলেছি বেশি করে, তাই স্বল্প সময়ের মাঝে যতটুকু নিজেকে প্রকাশ করা যায়।এই কবিতাই আমার মানসপ্রতিমা। সময় আমার কাছে মস্ত বাধা,সামাজিক, সাংসারিক ও বিভিন্ন মানবিক কাজের সংস্পর্শে সময় অতিবাহিত  হয়ে যায়,আবার পেশাগত কারণও আছে ।এরই মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে কবিতা চর্চা করে মনটা হালকা করে নিতে চাই । 



৩)       আপনার লেখালেখির শুরু সম্পর্কে কিছু জানান।অর্থাৎ কবিতার প্রতি এই টান কখন থেকে জন্মালো? 


উত্তর : আমার লেখালেখির শুরুটা মুলত আটের দশকের প্রথম দিকে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি,বয়স ১০,কোলকাতা থেকে ফিরে এসে ৮~১০ লাইনের কবিতা ••" ও আমার সোনালি ধান/তোমার জন্য বেড়াই সারাক্ষণ /তুমি হাসাও জীবন, কাঁদাও জীবন /,করো আবার জীবন দান •••," বাকি মনে পড়ে না। লেখাটা হারিয়ে গেছে ।১৯৭৪ সালে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি থেকে প্রকাশিত "মশাল" পত্রিকায় " আমরা বাঙালি " কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ধীরে ধীরে বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি । কলেজে পড়ার সময়ে "বীরভূম অগ্নিশিখা" সাপ্তাহিক পত্রিকাতে সাংবাদিকতা সহ নিয়মিত ফিচার, বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখতাম। "সাপ্তাহিক দিদিভাই "পত্রিকার সাথে জড়িত হই ও মাসিক দিদিভাই পত্রিকাতে প্রথম "তিন পাহাড়ের কাহিনী '' নামে কপ্পনাশ্রিত গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯৮২~৮৩ হবে, দিদিভাই শারদীয়া পত্রিকাতে "অবিনাশও মরে গেছে " গল্পটা প্রকাশিত হলে, জেলার কয়েকটি পত্রিকাতে পুনর্মুদ্রিত হয়। 
ঐ সময়েই কোলকাতা থেকে প্রকাশিত "দামাল" সাপ্তাহিক কাগজে নিয়মিত কবিতা ও গল্প লিখতাম। ১৯৮০ তে বৈকালিক আড্ডা নামে প্রতিদিন সন্ধের দিকে মুরারই-এ বাসন্তী দত্তের বাড়িতে আমাদের আড্ডা বসত,কবিতা গল্প নিয়ে আলোচনা হতো । তারপর,অরুণ মুখার্জি  (আনন্দবাজারের সাংবাদিক) এর "কোরাস কণ্ঠ ", "বীরভূম প্রান্তিক "পত্রিকাতে যুক্ত হয়ে পড়ি। মাঝে "নতুন গতি"তে এবং বর্তমানে " কলম" ছাড়াও বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে লিখছি । কবিতাই আমার বেশি পছন্দের ।



৪)         এখন পর্যন্ত আপনার কতগুলো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে ও কী কী? 


উত্তর :    প্রথমেই বলেছি ,আটের দশকে লেখালেখি শুরু হলেও কোনদিনই লেখার ধারাবাহিকতা ছিল না, ফলে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কথা ভাবিনি, আর্থিক কারণও অন্যতম। বীরভূম প্রান্তিক সম্পাদক সুনীল দত্ত আমার কিছু কবিতা বাছাই করে দেয়, কাঞ্চীদেশ প্রকাশনী থেকে কাব্যগ্রন্থ " বুক ছুঁয়েছি নগ্ন রাতে "(২০০৬) প্রকাশিত হয়। কলকাতার " কবিতা প্রতিমাসে" গোবিন্দ মণ্ডল রোড থেকে "ফুল ও অভিমানী ইচ্ছেরা" (২০০৭)কবিতার বই প্রকাশিত হয়। যৌথ কবিতা সংকলন কিছু আছে। ২০১১ তে কাঞ্চীদেশ থেকে "অথবা অন্য পৃথিবী " নামে গল্পগ্রন্থ বের হয়। আগামীতে "দৌড়''থেকে একখানা কাব্যগ্রন্থ বের হওয়ার কথা ।  



৫)          বর্তমানে বাংলা কবিতা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?  


উত্তর :   বাংলা কবিতার অবস্থান নিয়ে অনেক কথা বলার আছে। নানা জনের নানান অভিমত তো থাকবেই। কেউ আধুনিকতার কথা, কেউ বা উত্তর-আধুনিকতা,আবার কেউ কেউ পূনরাধুনিকতার কথা বলছেন । কিন্তু যে যাই বলুক, কবিতা প্রতিনিয়ত গতিপথ পরিবর্তন করে এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় শাণিত হচ্ছে। বিশ্ব সাহিত্যে কবিতার বহুমাত্রিক লক্ষণ প্রতিভাত হচ্ছে। নতুন আঙ্গিকে, নিত্য নতুন ভাব ভালবাসার মিশেলে চিত্রকল্প চিত্রণের ভেতর শব্দ ব্যঞ্জনার দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়ে কবিতামহিমময় হয়ে উঠছে ।কবিতা সাবালক হয়ে ওঠে বিমূর্ত ধারণা , ঐন্দ্রজালিক চিন্তার কুহক ভেদ করে,বাধা টপকিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো, শূন্যে ভাসতে চাইছে। কবিতার অবস্থান অনেক উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে, বাংলা কবিতা অনেক পুষ্ট ও সাবলম্বী হয়েছে । 


৬)      বর্তমানে কিছু তরুণ কবিদের মধ্যে কবিতা নিয়ে একটা পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই ।

উত্তর :  আগেই বলেছি, কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। তবে এটা খুব ভাল লক্ষণ যে, কিছু তরুণ এগিয়ে আসছে। কবিতা লেখাকে অনেকেই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর সাথে তুলনা করে। তরুণদের এভাবে আসাকে স্বাগত জানাচ্ছি। তরুণেরা যেভাবে কবিতার ব্যবচ্ছেদ করছে, নতুন ভাবনার জারক রসে সিক্ত করে পরিবেশন করছে, তাতে কবিতার ভালই হবে আমার বিশ্বাস।নতুন নতুন আঙ্গিকের  উপর জোর দেওয়া, কল্পনাবিলাসী না হয়ে বাস্তব জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা নিয়ে শব্দের খেলা চালু হয়েছে, কবিতার বিমুক্তিকরণ হচ্ছে, তা আগামীতে কবিতা পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে,পাঠকও নতুনের ছোঁয়া পেয়ে আপ্লুত হচ্ছে। কবিতার ভাঙাগড়া --নির্মাণ--বিনির্মাণ ক্রিয়ার ভেতর জিরো তাদের সামনে নতুন দিশা তুলে ধরেছে, একথা বলতেই  হবে । তরুণেরা যে ভাবছে এটা আমার কাছে খুব যুগোপযোগী চিন্তা চেতনা থেকে সঞ্জাত বলে মনে হচ্ছে । এককথায় শুভ লক্ষণ, কবিতা গতি পাবে ।


৭)        এতদিন ধরে কবিতার মধ্যে রয়েছেন । কোনো বিশেষ সময়ের কথা বলবেন যা আপনাকে ও আপনার কবিতাকে প্রভাবিত করেছে।

উত্তর :  আমার কবিতা যাপন দীর্ঘ, কিন্তু তেমন উৎকৃষ্ট কবিতা লিখতে পারলাম কই। মনের আত্মতৃপ্তি জন্য কবিতা চর্চা। পাড়াগ্রামে বড় হয়েছি, কবিতা,শিল্প, সাহিত্য নিয়ে পড়ার সুযোগ কম, ফলে গতানুগতিক কবিতা লিখে সুখ উপভোগ করতাম। বিশ্বজুড়ে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে যে লড়াই চলছে,সমাজের পরিবর্তন দ্রুতগতিতে ঘটছে তেমনি কবিতার পরিবর্তন ঘটছে,তা বুঝতে সময় লেগেছে।কবি তৈমুর খান কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন সময়ের কথা, কালখণ্ডের বিচারে কবিতা বিষয়বস্তু কী হওয়া দরকার, শব্দের ব্যবহার,স্পেইস এর প্রয়োজনীয়তা,নাথিংনেস বা এম্পটিনেস ধারণা নিয়ে, আমি উৎসাহ বোধ করি । নতুন করে কবিতা যাপনে ঢুকে পড়ি।বিশ্বের নানা সংকট যেমন, অর্থনৈতিক,সামাজিক,সংস্কৃতি বিচ্ছিন্নতাবাদ,মানব যন্ত্রণা,জাতিবিদ্বেষ,দারিদ্র, বেকারীবৃদ্ধি,সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ,পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। এই সময়ই আমার কবিতাকে প্রভাবিত করেছে নিঃসন্দেহে ।


৮)       একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছে করছে সেটা হলো কবিতা লেখার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার কতটা প্রভাব থাকে বলে আপনি মনে করেন?  নাকি আদৌ কোনো প্রভাব তার থাকে না?  

উত্তর :   এটা খুব বিতর্কিত ও গ্রহণযোগ্য কথা বলা চলে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো কবিতা, সাহিত্য আলোচনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার আলাদা মর্যাদা আছে। একজন স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তি ও একজন পি,এইচ ডি ডিগ্রি অর্জনকারীর মধ্যে অতি অবশ্যই মৌলিক তফাত আছে। অবশ্য আমার মতের বিরুদ্ধ অনেকে থাকবেন, তাঁরা অনেক উদাহরণ দিতে পারবেন। উচ্চ শিক্ষা কবির কাছে বাড়তি সুযোগ। উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তির বিভিন্ন জ্ঞানার্জন ও অভিজ্ঞতা,সময়ের ধারণা সম্পর্কিত জ্ঞান সাহিত্য সৃষ্টির অন্যতম উপাদান। ফলে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না । একে অনুঘটকও বলতে পারি ।


৯)       আমি প্রথমেই জানতে চাইবো আপনি আফজল আলি প্রতিষ্ঠিত ও লিখিত "জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট " পড়েছেন এবং পড়ে থাকলে আপনার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী?

উত্তর :   জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট -এর বিষয়ে ইতিমধ্যে একটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। একাংশ পাঠকের কাছে এর বার্তা পৌঁছেছে, ফলে এর সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তাদের তৈরি হয়েছে । কুমারেশ-এর জিজ্ঞাসার উত্তর অতি সংক্ষেপে আমার সাধ্যমত দেওয়ার চেষ্টা করব। David Hintun-এর ইংরেজি অনুবাদে BEI DAO- এর একটি কবিতা পড়েছি, তার একটি পংক্তি এরকম --"hurry a lion into the cage of music / hurry stone to masquerade as a recause /moving in parallel nights••" কবিতাটির মধ্যে শব্দের প্রয়োগ কৌশল, বিমূর্ত শৈলী নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করে। আফজল আলির জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট আলোচনা করতে গিয়ে ঐ কবিতার কথা মনে পড়ে, কী চমৎকার একটা নতুন ধারণা যা জিরোর সাথে মিশে আছে। অথচ,দেখা যাচ্ছে জিরো কী সুন্দর করে আমাদের কবিতা সৃজনের ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করে দিতে চায়। ভাবনা চিন্তার পরিশীলন,শব্দের উদ্ভাবনীশক্তির ব্যবহার,শব্দ, শব-বন্ধের অবাধ বিচরণ,কবিতার মধ্যেকার বলা না-বলার আরোহন,অবরোহন-যা এক কথন থেকে অন্য কথনে অর্থাৎ shift from one angle to another, one aspect to another, অনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় গমন করে, তখন কবি স্বস্তি পান, মুক্তি পায় চিন্তা, মুক্ত হয় কবিতার ভাব, ভাষা। জিরোর এখানেই সর্বজনগ্রাহ্যতা বিদ্যমান। 


১০)        জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্টে সমাজের অবস্থানের কথা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে আপনার কী মতামত? অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি এই কনসেপ্ট সমাজকে কতখানি প্রভাবিত করতে পারে। 

উত্তর :    মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজ ব্যতিরেকে মানুষ বাঁচতে পারে না।সামাজিক পরিবেশ তথা বাস্তব জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা,রহস্যময় ও লীলাচপল বিশ্ব প্রকৃতির বিপুল জীবজগৎকে নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা,সামাজিক ক্রিয়াকলাপ, সম্পদ, বস্তু ও মানব দর্শনের প্রতীক্ষ্যকরণের সূত্র ধরে - কবির কলম হেঁটে চলে নানা ভঙ্গিতে। illusion of illusion, প্লেটোর মতে। " The truth poetry is not a copy of reality, but a higher reality,"সুতরাং সমাজকে উপেক্ষা করে, সমাজের অবস্থানকে বাদ দিয়ে কবিতার ভাষা হতে পারে না,কাব্য শিল্প হতে পারে না। জিরো সেই কথাটা বলে আসছে, জিরো সমাজকেন্দ্রিক ভাবনাকে অধিক গুরুত্ব দেয়,-- সমাজের উত্থান পতন, সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তার ভাঁজ সংস্করণও জিরোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নিঃসন্দেহে জিরোর ভাবনা সমাজের অপ-গুণ সমূহের অবসানে, সুকল্যাণমূলক কাজের ভেতর সমাজ গঠনে এগিয়ে যাওয়া।এক কথায় জিরো সমাজ পরিবর্তনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করবে।


১১)        এই কনসেপ্টের স্রষ্টা আফজল আলি 'a state of liberty '--কথা বলতে গিয়ে বলেছেন " মানুষের চিন্তাধারায় এক অখণ্ড রূপ, এক অখণ্ড পৃথিবী ঘোরাঘুরি করে, কারণ জন্মায় মুক্ত হয়ে ।" এই প্রসঙ্গে আপনার ব্যাখ্যা কী?

উত্তর :     জিরোতে "a state of liberty '' র কথা বলা হয়েছে । এটা অতি বাস্তব ও অমলিন সত্য যে, মানুষ জন্মায় শূন্য জ্ঞান নিয়ে ।দর্শনের ছাত্র হিসেবে জানি যে, প্রত্যেক শিশু জন্মের সময় 'কোড়া কাগজ '' ' tabula rasa' হয়ে জন্মে। ঠিক একখানা পরিস্কার ঝকঝকে সাদা কাগজ । জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীর নানান অভিজ্ঞতা তার মনে আঁচড় কাটতে থাকে, সেই দাগ হৃদয়কে অঙ্কিত,শিল্পিত করে তোলে। দ্বিমতও আবার আছে, দার্শনিক বুদ্ধিবাদীগণ না মেনে অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যাক ওকথা, তবে, আমি মনে করি যে, শিশু কোনো পূর্ব- অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান নিয়ে জন্মায় না। অসীম শূন্যতা --সেই শূন্যতা পৃরণ হয় সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা লব্ধ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। মানুষের চিন্তাধারার মধ্যে এক অখণ্ড পৃথিবীর অখণ্ড রূপ প্রতিভাসিত হয়। অনেকে বলেন, আমরা সারাজীবনে একটিমাত্র কবিতা লিখি-,খণ্ড খণ্ড রূপে। বর্তমানে বিশ্বায়ণের ফলে ইন্টারনেট, ফেসবুকের দৌলতে, দ্রুতগতিতে আমার বক্তব্য ক্ষনেকের মধ্যে বিশ্বময় হয়ে যাচ্ছে। কী ভাবছি, কী করতে চাইছি, কোনটা ঠিক, আর কোনটা বেঠিক তা বিবেচ্য হয়ে পড়ছে। ছড়িয়ে দেওয়া সহজতর হয়েছে, ফলে অবকাশ ঘটছে উন্মুক্ত স্বাধীনতার, চিন্তার উন্মুক্তি -- স্বাধীনতা ও চিন্তনে মুক্তি--মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার সক্ষমতা--"সৃজনশীল কল্পনা " প্রকৃতই এক অভাবনীয় নির্মাণক্ষম প্রজ্ঞা। বাস্তব জগৎ ও জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা বা বস্তুকে উন্মুক্ত রসে রঞ্জিত করে বি-মুক্তি ঘটানোর সুযোগ রয়েছে।কল্পনার সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া কবির কাজ। কেউ বাধা দিতে আসবে না, ভাবনার মুক্তি, কাব্যের সত্যতা, ঐতিহাসিক সত্যের চাইতে বেশি মহিমময় ও চিরায়ত। সুতরাং কবি এক অখণ্ড পৃথিবীর সত্ত্বাসমূহকে অবলোকন করে মুক্ত চিন্তনের দ্বারা অলংকৃত করছেন বা করবেন, জিরো সেই পথ নির্দেশ করে ।


১২)        আফজল আলি বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আধুনিকতা বা উত্তর আধুনিকতা তাদের প্রাসঙ্গিকতা ক্রমশঃ হারিয়েছে বা হারাচ্ছে। এর ফলে তো কাব্য, সাহিত্য এবং শিল্প জগতে একটা শূন্যস্থান নিশ্চয়ই তৈরি হচ্ছে বা হবে।আপনি কি মনে করেন জিরো বাউন্ডারি ধারণা এই শূন্যস্থানকে পূরণ করতে সক্ষম, যদি মনে করেন তবে কেন? 

উত্তর :     আধুনিকতার জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকেই, অনেকে' আধুনিক' বা ' মডার্ন' কে একটা অত্যন্ত আপেক্ষিক শব্দ বলে মনে করে। "নতুন সময়ে নতুন ও নতুন ভাবে নির্নিত পুরোনো মূল্য, নতুন চেতনা এবং নতুনভাবে আবিস্কৃত পুরোনো চেতনার যে একান্ত দরকার শিল্পে ও জীবনে একালের কোনো কোনো বাঙালি কবি সেটা বুঝতে পেরেছেন ''-- জীবনানন্দ দাসের কথায় একটা ধারণা দেওয়া হল। নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাত,জীবনে ক্লান্তি ও নৈরাশ্যবাদ রূপকের বদলে প্রতিকাশ্রয়ী হয়ে ওঠা,মননধর্মিতা,দেহজ কামনা, বাসনা ও তৎপ্রসূত অনুভূতিকে স্বীকার করে-- প্রথাগত ধর্মের অস্বীকারের মধ্য দিয়ে যে চেতনার আবির্ভাব, তা কালক্রমে অবসন্ন হচ্ছে। একসময়ে মানুষ নতুনকে গ্রহণ করে, পুরাতনী ধ্যান ধারনা বিবমিষা হয়ে দাঁড়ায়, নতুন খাদ্যান্বেষণ করতে থাকে, কিন্তু কালক্রমে সেটাও অখাদ্য লাগে। নতুন স্বাদ গ্রহণের উদ্দেশ্যে আর এক ধাপ এগিয়ে যেতে চায়, চলে আসে উত্তর আধুনিকতার চিন্তা ভাবনা, নতুনতর ভাবনার উপাদান উৎপত্তি থেকেই। উত্তর আধুনিকতা প্রসঙ্গে লিওতার বলেন যে, "আদিম সাম্যবাদ,পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আলাদা আলাদা জবানি থাকতে পারে, কিন্তু ঐতিহাসিক বস্তুবাদের জবানিতে সৃষ্টি সেটা ভ্রান্ত "--এই দর্শনের মূলে আছে বিষয়গত বাস্তবতার(Objective Reality ) অস্বীকার। জগতের অস্তিত্ব কেবল একান্তভাবেই বিষয়ীগত (Subjective),বিশ্বায়ণ ও উত্তর আধুনিকতার পরস্পর নির্ভরতার --সর্বোচ্চ ক্ষেত্র হল পরিচয় ভিত্তিক রাজনীতি। মানুষের কোনো অখণ্ড সামগ্রিক পরিচয় নেই-- হাজার সত্তায় বিভক্ত--। জিরো বলছে,মানুষের চিন্তাধারায় এক অখণ্ড রূপ এক অখণ্ড পৃথিবীর ঘোরাঘুরির কারণে --মানুষ মুক্ত হয়ে জন্মায়। যার ফলে আমরা অতি অল্প বাক্য ব্যয়ে বলতে পারি,জিরো উত্তর আধুনিকতার ভাবনা চিন্তার উর্ধে। উত্তর আধুনিকতার বেঁধে দেওয়া বেড়া,boundary বা limitation কে খণ্ড খণ্ড সস্তায় বেঁধে রাখতে চেয়েছে-- জিরো তাকে ভেঙেচুরে delimitation পর্যায়ে উন্নীত করার কথা বলছে। ফলে কালের বিচারে উত্তর আধুনিকতা চিন্তার --সীমাবদ্ধতাকে মানুষ মেনে নিতে চাইছে না, মানুষ উন্মুক্তির পথে উন্নীত চিন্তার খোরাক নিয়ে উন্নত মনস্কের শরীক হতে চাইছে,এখানেই জিরোর সাফল্য। এর সাথে এটা নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে যে, উত্তর আধুনিকতার পরে একটা শূন্যতা থেকে গেছে। বর্তমান বিশ্বে এক মেরু কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের ব্যাপকতা বৃদ্ধি, ব্রিটিশ লেবার পার্টির ভোটাধিক্য ,দেশে দেশে অস্থিরতা,গণতান্ত্রিক কোরিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা উত্তেজনা, চীনের 'নতুন যুগ তত্ত্ব '(Theory of New Era) মায়ানমার সমস্যা, ভারত-চীন, ভারত-পাক সীমানা সমস্যা, দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট, নোটবন্দী খেলা, বিভিন্ন সৌধ নিয়ে রাজনৈতিক চাপান উতোর ইত্যাদির ফলে একটা শূন্যতা বিরাজ করছে। যদিও এগুলো রাজনৈতিক শূন্যতা কিন্তু শিল্প সাহিত্যে রাজনৈতিক প্রভাব যথেষ্ট বিদ্যমান থাকায় শিল্পে ও সাহিত্যে শূন্যতা দেখা দিয়েছে।উদারনৈতিক চিন্তা করার সুযোগ, শব্দের ব্যবহারে জোর,শব্দের বহুগামিতার উচ্ছ্বাস, চিন্তনের বিকাশে জিরোর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে যাচ্ছে।কারণ জিরোর বৈশিষ্ট্য সেই কথাগুলো বলছে যে, কোনো বেরিয়ার নেই, কবিতা যথেচ্ছগমণ করতে পারে,ছন্দের দোলায় দুলতে পারে, শব্দের নতুন অর্থের সন্ধান দিতে পারে, নতুনত্বের ছোঁয়ায় হৃদয় পুলকিত করতে পারে--মানুষ নতুনকে যুগে যুগে গ্রহণ করেছে, ফলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জিরো সেই শূন্যতাকে পূরণ করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য হাতিয়ার ।

১৩)         আফজল আলির মতে সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষ শৃঙ্খলিত থাকতেই ভালোবাসে।তবে সৃজনের ক্ষেত্রে সে চায় পূর্ণ স্বাধীনতা। জিরো কি সেই পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে সক্ষম যেখানে সৃজনের ক্ষেত্রে সীমার মধ্যে থেকেও তার উড়াল হয়ে উঠবে অসীম। 


উত্তর :       মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, তাই শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে পারে। আদিম সমাজে মানুষ শৃঙ্খলা মেনে চলতে চাইত না, ফলে পশুদের হাতে হত হতো ।অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান থেকে পরবর্তীতে তারা যৌথভাবে থাকতে শুরু করে ।মস্তিষ্কের বিকাশের সাথে সাথে আগুনের ব্যবহার শিখে জীবন রক্ষার তাগিদে বিশৃঙ্খলা থেকে সুশৃঙ্খলের পথে চলতে থাকে। কিন্তু সৃজনশীলতায় তারা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে চেয়েছে।সৃষ্টির সময়ে অভিজ্ঞতা,প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও বিবেক দ্বারা পরিশীলিত হয়ে উন্নত সৃজনে স্বাধীনভাবে দক্ষতা প্রয়োগ করে থাকে।এভাবেই ক্লাসিক সাহিত্য থেকে আজকের ম্যাজিক রিয়ালিজম সাহিত্যের ক্রমবিকাশ ।চিন্তার বহিঃপ্রকাশই সৃষ্টির নতুন পথের সন্ধান বহে আনে,স্বেচ্ছাধীন রূপ, মূর্তের প্রকাশ ও কল্পনার বিকাশ ঘটে স্বাধীন চিন্তার মাধ্যমে ।
জিরো মানুষের কল্পনা বিলাসী মনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে চাইছে। বিশেষ করে শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী শক্তির উন্মুক্তি ঘটিয়ে, কবিতা বা শিল্পের process এর ভেতর দিয়ে স্বাধীনত ভাবে প্রকাশ করতে সহায়তা করে। এখানে elimination কম inclusionবেশি। এখানে সীমানা টপকে যাওয়ার সুযোগ বেশি, কবিতার অঞ্চল এক্কেবারে উন্মুক্ত, জীবন থেকে শূন্যে --আবার শূন্য থেকে সর্বক্ষেত্রে- জ্ঞান সচেতনের সকল শাখায়। তাই,মুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব। 


১৪)           জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্টে বলা হয়েছে ব্রহ্মাণ্ডে এক স্পেইসের কথা মুক্ত গমনের জন্য।কাব্য বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেই স্পেইস আগামীতে জিরোধর্মী কাব্য ও সাহিত্যকে কতটা প্রভাবিত করবে বলে আপনার মত এবং কেন? 

উত্তর :        শিল্প সৃষ্টির মধ্যে নিহিত আছে স্বাধীনতা, কিন্তু স্বেচ্ছাচারী স্বাধীনতা নয়,যা সুসজ্জিত ও রূপমণ্ডিত। মানুষ প্রকৃতির মধ্যে   adopted বৃদ্ধি মস্তিষ্কের অধিকারী,মানুষের মন কোনো ঘেরাটোপ পছন্দ করে না,ফলে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যে space বা শূন্যস্থান আছে তা মনের উন্মুক্তির উদ্দেশ্যে। সময়ের নতুন বিন্যাসে আবেগ তাড়িত হয়ে সময়ের চাহিদাকে কাজে লাগাতে চায় space সেই সুযোগ করে দেয়। জিরোধর্মী কাব্য ও সাহিত্যে নতুন ভাবনার ক্ষেত্রে liberty বা মুক্তন ভাবকে প্রকৃতির বাঁধন ছিন্ন করতে সহায়তা করে।মুক্ত চিন্তনের ভাববোধ না থাকলে শিল্প বা সৃষ্টি রূপের প্রকাশ ঘটত না। যেহেতু পৃথিবী বা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আকর্ষণ --বিকর্ষণ জনিত ক্ষমতা ক্ষেত্রে এক বন্ধনে আবদ্ধ পরিকাঠামোগত কারণে, তাই রূপ আঙ্গিকের জন্য ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে space থাকে তা মুক্ত গমনের উদ্দেশ্যেই আছে।জিরো সেটাকেই ইঙ্গিত করে যেটা সাহিত্য, শিল্পে তার প্রভাব জুড়ে থাকে।


১৫)         এই কনসেপ্টে এক অখণ্ড পৃথিবী অখণ্ড মানবজাতি অর্থাৎ বিশ্বায়নের কথা বলা হচ্ছে।এ কি শুধু কল্পনা নাকি ববাস্তবতা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন? এ ক্ষেত্রে জিরো কাব্য -সাহিত্য কী ভূমিকা পালন করতে পারে?

উত্তর :      এক অখণ্ড পৃথিবী অখণ্ড মানব জাতির ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের দুটো দিক -প্রথমতঃ আর্থ-রাজনৈতিক বিশ্বায়ন, দ্বিতীয়তঃ সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন। পুঁজির বিকাশ বাড়লে,লগ্নি পুঁজির দাপটে বিশ্বায়নের বিকাশে কালিমালিপ্ত হবে। বিশ্বে দুই শ্রেণির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষিত না হলে তার প্রভাব শিল্প ও সাহিত্যে পড়ে। সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি পাল্টাতে অর্থনীতির একটা ভূমিকা থাকে। শ্রেণি শোষণের হাত ধরে অসহিষ্ণুতা বাড়ে, তখন মানুষ পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে,গণজাগরণ ঘটে। নদীর প্রবল গতি যেমন সাগরের শান্ত জলে স্তব্ধ হয়ে যায়,তেমনি বিশ্বায়নের সুফলও আংশিক ভাবে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হয়। অবশ্যই তার চারিত্রিক গুণাবলীর মধ্যে এই কথাগুলোই জোরের সাথে বলতে চেয়েছে। পৃথিবী একদেশ হলে দেশে দেশে অশান্তি,বিদ্বেষ কমে যাওয়ার কথা, অপরাধ প্রবনতা কম হলে মিলিটারি খাতের খরচ অনেকটা কমে যাবে, সেই টাকা মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হবে, শিল্প, সাহিত্য,সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধি ঘটবে, super power হিসেবে মানবজাতি উন্নত হবে, শ্রেণি শোষণের বিমুক্তিকরণ ঘটবে। যেহেতু মানুষ পৃথিবী সৃষ্টি করেনি, তাহলে পৃথিবী ও মানুষ পরস্পর compactness এ সমন্বিত।জাত বিভেদ বিলুপ্ত হবে, পরিচিতি সত্তার অবসান ঘটবে, এক অখণ্ড মানবজাতি বিরাজ করবে যা জিরোর ঐকান্তিক অভিপ্রায়।


১৬)         কবিতায় হৃদয়ের একটা বড়ো ভূমিকা থাকা উচিত বলে জিরো মনে করে।অর্থাৎ কবিতায় থাকবে হৃদয়ের ছোঁয়া। আপনি কি এই ব্যাপারে জিরোর মতকে সমর্থন করেন বা করলে কেন করেন? 

উত্তর :       " কবিতায় থাকবে হৃদয়ের ছোঁয়া "-- জিরোর এই ভাবনাকে সমর্থন করে বলতে চাই যে, হৃদয়হীন কবিতা আমার কাছে অ-কবিতা। হৃদয় জারিত রসসিক্ত হয়ে যে কথন ভেসে আসে, তাতে থাকে মাধুর্য, সহমর্মিতা, সংগ্রামমুখিনতা ও পরোপকারী চিন্তা যা বিশ্ব চেতনায় সম্পৃক্ত। মেধা,বুদ্ধি বা মস্তিষ্কের ব্যবহার  যাই বলি না কেন হৃদয়ের চাইতে বড়ো নয়। কোনো শব্দ বা পংক্তি যদি হৃদয়কে নাড়া দেয়, মনকে ছুঁয়ে না ফেলে তা কীভাবে কবিতার পর্যায়ে উন্নীত হবে। জিরো চাইছে, দুটোর মধ্যে সমন্বয় সাধন, মেলবন্ধন ঘটিয়ে তোলা পাঠক ও কবির মধ্যে। সেই গতিশীল চিন্তা ভাবনার তত্ত্বকে জিরো পাঠক ও লেখকের সেতুবন্ধন হিসেবে ব্যবহৃত করতে চায়। সুতরাং সমর্থন না করার কোনো কথাই আসে না । 


১৭)           উত্তর আধুনিক বলেছিল কবিতার ভাবনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা। জিরো বাউন্ডারি বলছে কবিতার বিভিন্নতা বা বহুধর্মিতা  বা বহুগামিতার কথা। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কী? 

উত্তর  :       উত্তর আধুনিকতাবাদ আসলে আধুনিকতার বিরোধী, ডাডাইজমকে সমর্থন করে। ডাডাইজম সাহিত্যে ও শিল্প জীবনে যা কিছু চিরাচরিত ও প্রাচীন ভাবনা তাকে নির্মমভাবে ধ্বংস করে--ওলট পালট করে,নতুন করে বিনির্মাণ ঘটানো এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শব্দকে পর পর জুড়ে কাব্য রচনা করা, যাতে কোনো কাব্যময়তা থাকে না --উদ্ভট কল্পনাকে ছড়িয়ে দিয়ে অনাদর্শিক চিন্তার প্রকরণ টেনে আনা। তাই এই মতবাদ স্থায়ী হতে পারেনি ।স্যুররিয়ালিজম খানিকটা সেই শূন্যতা পূরণ করতে পেরেছে। অবচেতন মনের ভাবগুলিকে যথাযথভাবে প্রকাশ করাই এর উদ্দেশ্য ও সৃষ্টির অব-নির্মাণ বা বি-নির্মাণ ঘটিয়ে দেওয়া।নির্দিষ্ট কোনো সীমানা থাকবে না, নির্দিষ্ট কাঠামোর আবদ্ধতা,অর্থময়তা, উদ্দেশ্য নির্ভরতা,নির্মাণের দায়,সমৃদ্ধির দাবি, যুক্তির শাসন,সমন্বয় প্রভৃতিকে সফলভাবে মুক্ত করা। জিরোর চিন্তা ও চিন্তন মুক্তির সাথে উত্তর আধুনিকতার উন্মুক্তি একরকম নয়- জিরোতে spice poetry র কথা বলা হচ্ছে, যা ডাডাইজমের মতো বিশৃঙ্খল নয়-- সুসজ্জিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ, প্রণালীযূক্ত কবিতা, যা হৃদয়কে উদ্রেক করে, মন তৃপ্ত হয়,যা শিল্প সুষমামণ্ডিত--genuine poetry হিসেবে পরিগণিত হয়। কবি এলিয়েট-এর কথা যে, " a genuine society can cumunicated before it is understood." কবিতার অন্যান্য বার্তাটি সহৃদয় পাঠকের মনোজগতে বিচরণ করবে। জিরোর কবিতা বহুদিকে বিভিন্নরূপে ছড়িয়ে যাবে একথাই প্রযোজ্য ।


১৮)          কবিতার ক্ষেত্রে জিরো স্বাধীনতা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে একটা সাবধান বাণীও থাকছে কবিতাকে জিরো উত্তীর্ণ হতে হবে যেমন শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে এক ফোর্স অ্যাপ্লায়ের কথা বলা হচ্ছে। এই ব্যাপারটা জিরোর পাঠকদের জন্য একটু বুঝিয়ে বলুন ।

উত্তর  :       কবিতার ক্ষেত্রে জিরো স্বাধীনতা দিচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। জিরো কবিকে কবিতা লিখতে যেমন স্বাধীনতা দিচ্ছে, তেমনি আবার কবিতা, অ-কবিতার পৃথকীকরণ ,বিয়োজন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ঘটবে, সেকথা স্পষ্ট করে বলছে ।শিল্প বা কবিতায় সাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ যা অনেকের কবিতায় একরকম version দেখা যায়,যা unedited poetry বলে চিহ্নিত। শব্দকে ব্যবহার করতে গিয়ে force apply  এর যে কথা বলা হয়েছে, তাতে কবিদের পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে।কবিতা হয়ে ওঠা একটা আপেক্ষিক ধারনা, এর কোনো অবয়ব বা কাঠামো নেই। কবির মুন্সিয়ানাই কবিতা হয়ে উঠতে সহায়তা করে। কবিতা হওয়ার ক্ষেত্রে time যেটা সমসাময়িক ও অনাগত এবং তাতে force apply হলো একটা factor. বিশেষত বর্তমান সময়কে কেন্দ্রীয়ভাবে রেখে শব্দের সাথে শব্দের বন্ধন বা শব্দ-বন্ধ তৈরি করে বা involment এমনভাবে হবে যা মুক্তভাবে কেবল আগত ও অনাগত ভাবনাসমূহকে সামনে রাখবে এবং শব্দ গাঁথার ক্ষেত্রে কতটা শক্তি প্রয়োগ প্রয়োজন তা বিবেচনা করে কবিতার শব্দবন্ধন দিয়ে আঙ্গিকে গেঁথে কবিতা সৃজন ঘটানো। এ কাজে যে যতটা বেশি দক্ষতা দেখাতে পারবেন, তাঁর কবিতা ততবেশি শক্তিশালী ও উত্তীর্ণ হবে। তাই সর্বদা লেখনীর মধ্যে advancement এর tendency  কে মান্যতা দিতে হবে। এই force apply  ক্ষেত্রে কবির নিরীক্ষণ, অভিজ্ঞতা,প্রতিভা, চিন্তার তীব্রতা ও মেলবন্ধন যুক্তিগ্রাহ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কবিতাগুলো eliminate হয়ে যাবে, ও প্রকৃত কবিতা automatic process এর ভেতর চলে আসবে।কাব্যময়তা,চিত্রকল্প, সৌষ্ঠব কবিতার অপরাপর গুণাবলী। অনাগত কাব্যময়তা নতুন ভুবনকে স্বাগত জানায়। দুই বিপরীতমুখী শব্দ কিংবা পরিসরের অভিব্যক্তি,স্বল্প বাক্যে প্রকাশ, রূপকের ব্যবহার পরিহার, শব্দের মোচড় সৃষ্টি করা, এক শব্দ থেকে অন্য শব্দে যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা বাঁক,কতক huddle অতিক্রম করে পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই চলা, পরস্পর বিরোধী গুণের সন্নিবেশ কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। এককথায়,কবিতা এক জীবন, যা ব্যক্তি সত্তার মতো উজ্জ্বল।
        এইবার কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই : " স্বপ্ন থাবা বসিয়ে ছিল রাতে / উন্মুক্ত! কী কী! উন্মুক্ত কোথায় ছিল / অন্ধকার তো তোমাকে •••" বা " মুঠোয় জোনাকি রাখি / জোনাক রাখি মুঠোয় / সঞ্চয় এটুকুই / পিপাসা থাকুক কলসির ফুটোয়।"•••কিংবা •••" মনকে উজার করে উড়িয়ে দিলেম / মেঘে, মেঘবতী কন্যার কিশোরী দামে / শূন্যের দেওয়াল ঘিরে দিলেম / তোমার বরাবরের অভীপ্সা লাগামে /"••••"রোদ লুকোচুরি খেলে বাইরে আঁধার ভুবনে / ন্যায় অন্যায় ছায়া ঘাপটি মেরে রয়েছে গোপনে •••" আমার দৃষ্টিতে কবিতাংশগুলোতে   vertical thinking বা  horizonal thinking এর  পরিবর্তে liberal thinking এর প্রাধান্য বেশি। কবি তার শব্দকে বিভিন্ন ভাবনার রসে সিক্ত করে স্বাধীনভাবে পরিবেশনের দ্বারা পাঠককে রসাস্বিত করতে চেয়েছেন। 'স্বপ্ন ' আর 'উন্মুক্তি ' শব্দে ব্যঞ্জনাময়তার যে ইঙ্গিত যা কবিতার ক্ষেত্রে সময়ের expansion restore করে । তেমনি হাতের মুঠোয় জোনাকি আর কলসির ফুটোয় পিপাসা দুই বিপরীতধর্মী ভাবনা, এক নতুন বোধকে টেনে আনছে । মন উন্মুখ করা আর শূন্যের দেওয়াল বেঁধে ফেলার ভেতর এক অদ্ভূত দর্শন কাজ করছে। 'রোদ ' ,'আঁধার ','ন্যায় অন্যায়,'বিপরীত শব্দবন্ধ ও খেলার সাথে ঘাপটি মেরে বসে থাকার যে অনন্য চিত্রকল্প এক নতুনত্বের ছোঁয়ায় ও শৈলীতে পরিপূর্ণ। আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে, যা জিরোর ভাবনাকে সম্পৃক্ত করে। কবিরা জন্মসূত্রেই ছন্দের দোলায়, সুরের মুর্চ্ছনায় স্বপ্নদর্শী। অ্যারিস্টটল কাব্য ও সাহিত্যকে তাঁর ''অনুকৃতি" তত্ত্ব( Mimesis) দ্বারা পুনর্বাসন দিতে চেয়েছিলেন, " Probable impossibilities are to be the preffered to improbable possibilities, "প্লেটো তাঁর অনুকরন তত্ত্বের মাধ্যমে যে ঘেরাটোপ তৈরি করেছিলেন অ্যারিস্টটল এর mimesis, সেই আচরণকে মুক্ত করে সৃজনী সাহিত্যকে দিয়েছিল  Probability ও Necessity- নির্ভর এক ভিন্ন ও উচ্চতর অনুকৃতির বৈধতা ও মর্যাদা। যা পুরোটাই জিরোর বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত নতুন রূপে, নতুন কায়দা কৌশলের ভেতর । শেষে বলতে চাই যে, ভাষা, আঙ্গিক, দৃষ্টিভঙ্গীর যতই বিভিন্নতা থাক না কেন, শিল্প, সাহিত্য কখনও নিরাবয়র হতে পারে না । কবিতা হচ্ছে শব্দের নির্বাচন ও নির্বাচিত শব্দ আর চেতনার নিবিড় সমবায়ে রচিত। '' চুল কালো ; কালো যেকোনো রাত্রিও ''--

      পরিশেষে, জিরোর এই সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য কবি আফজল আলি ও তরুণ কবি কুমারেশ তেওয়ারী এবং জিরোর অন্যান্য বন্ধুদের, সর্বোপরি অগণিত পাঠক বন্ধুদের প্রতি আমার শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা, ও ভালবাসা জানাই ।জিরো প্রতিষ্ঠিত হবে এই প্রত্যাশা করছি ।সকলেই ভাল থাকবেন ।নমস্কার ।

0 comments:

Post a Comment